শান্তিরাজের আগমনের দিন - সাপ্তাহিক তুলসিগঙ্গা

Online Newspaper "The Weekly Tulsi Ganga"

Breaking

Home Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

শান্তিরাজের আগমনের দিন

শিল্পীর কল্পনায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মমুহূর্ত ।  ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
 ___শিল্পীর কল্পনায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মমুহূর্ত । ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত



                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                       

বিশেষ প্রতিবেদনঃ 

হজরত ঈসা (আ.) আমাদের ধর্মের অন্যতম নবী ও রাসুল। পরম করুণাময় তাঁর প্রতি কৃপা বর্ষণ করুন। যেসব নবী ও রাসুলের কথা কোরআন শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আমরা কোনো পার্থক্য করি না। তাঁরা সবাই আমাদের কাছে মর্যাদাশীল ও সম্মানীয় ব্যক্তি। যেসব ধর্মপুরুষের কথা আমাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত হয়নি, কিন্তু যাঁরা মানবকল্যাণে নিজের জীবন অতিবাহিত করেছেন, দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন, তাঁরাও আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র।
যিশুখ্রিষ্ট মানবতার জন্য দুঃখ আর ত্যাগের পথকে মহৎ বলে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁকে তাঁর শিষ্যরা দুঃখের মানুষ বলেন। সব মানুষের প্রতি প্রেমকে তিনি স্রষ্টার প্রতি প্রেমের সমার্থক করে ধর্মপথ রচনা করে গেছেন। মানুষ যে অমৃতের সন্তান, অমৃতের পুত্র-কন্যারা যে পরস্পরের বড় সহায়, এই বোধ তিনি জাগ্রত করে গেছেন। তিনি মানুষের ইতিহাসের আদিম সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষার আদি রূপকার। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় জগতের লাঞ্ছিত ও ভাগ্যাহতদের আপন মানুষ তিনি। দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষকে খ্রিষ্টের নিকটজন ভেবেছেন বলেই নজরুল বলতে পেরেছেন, ‘দারিদ্র্য, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান’। আমরা দেখেছি, দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষও যিশুখ্রিষ্টকে তাদের পরম সুহূদ গণ্য করেছে। আধুনিক কালে লাতিন আমেরিকার সংগ্রামী জাতিগুলোর মধ্যে মুক্তির ধর্মতত্ত্ব নামে যিশুখ্রিষ্টের প্রেরণার প্রতিষ্ঠাও আমরা দেখতে পাই। এই যিশু মাথায় কণ্টক মুকুট পরা যিশু, সোনার সিংহাসনে আসীন দূরের কেউ নন।
আবার আমরা এ-ও দেখেছি, দেশে-বিদেশে হজরত ঈসার (আ.) অনুসারীরা তাঁর মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠার নামে কী নিদারুণ যুদ্ধ, ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ করেছে। সৃষ্টিকর্তার পরম সৃষ্টি মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন এবং বৈষম্য-বঞ্চনার ক্ষমার অযোগ্য অপকর্ম করেছে। আর এর সবই ঘটেছে রাজ্য দখল, পরজাতি শাসন ও শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার খাতিরে।
গ্রামীণ গির্জায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মমুহূর্তের পুনর্নির্মাণ
এ জন্য সেসব নিপীড়িত জাতির মানুষ অধিপতিদের ধর্মকে একসময় বিরূপ চোখে দেখেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে এ অবস্থা ভারতবর্ষেও বিরাজ করেছিল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অবস্থা খেয়াল করে লিখছেন—
‘মহাত্মা যিশুর প্রতি আমরা অনেকদিন এইরূপ একটা বিদ্বেষভাব পোষণ করিয়াছি। আমরা তাঁহাকে হূদয়ে গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু এজন্য একলা আমাদিগকে দায়ী করা চলে না। আমাদের খৃষ্টের পরিচয় প্রধানত সাধারণ খৃষ্টান মিশনারিদের নিকট হইতে। খৃষ্টকে তাহারা খৃষ্টানি-দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের কাছে ধরিয়াছেন। এ পর্যন্ত বিশেষভাবে তাঁহাদের ধর্মমতের দ্বারা আমাদের ধর্মসংস্কারকে তাঁহারা পরাভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। সুতরাং আত্মরক্ষার চেষ্টায় আমরা লড়াই করিবার জন্যই প্রস্তুত হইয়া থাকি। ...সেই মত্ততার উত্তেজনায় আমরা খৃষ্টানকে আঘাত করিতে গিয়া খৃষ্টকেও আঘাত করিয়াছি। কিন্তু যাঁহারা জগতের মহাপুরুষ, শত্রু কল্পনা করিয়া তাঁহাদিগকে আঘাত করা আত্মঘাতেরই নামান্তর। বস্তুত শত্রুর প্রতি রাগ করিয়া আমরা আমাদেরই দেশের উচ্চ আদর্শকে খর্ব করিয়াছি— আপনাকে ক্ষুদ্র করিয়া দিয়াছি।’ যিশুচরিত, রবীন্দ্র রচনাবলী।
মানুষ করুণাময়ের ক্ষমার দাবিদার। কারণ, যিশুর অনুসারীদের অনেকে যেমন নানা ধরনের অমানবিক কর্মে লিপ্ত, তেমনি তাঁর শ্রদ্ধেয় অনুসারীরা মানবকল্যাণে নানা সুকর্মের অধিকারীও বটে। যিশুখ্রিষ্টের অনুসারীরা যেভাবে মানুষের সহায়তায় চিকিৎসা, সেবা ও শিক্ষার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেন, তেমন সুকর্ম প্রায়ই দেখা যায় না। সারা পৃথিবীতে তাঁরা বহু হাসপাতাল, মাতৃসদন ও শিশু পরিচর্যার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং সোৎসাহে অভীষ্ট কর্ম সাধন করেন। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য তরোয়াল ব্যবহার করার আগেই তাঁর এই মহৎ অনুসারীরা সম্ভাব্য দীক্ষিতদের জীবনাচার ও সমাজব্যবস্থা জানতে চান এবং তার বিবরণও লিখেছেন। যাদের লিখিত ভাষা ছিল না, তাদের তারা হরফ নির্ধারণ করেছেন। আমাদের বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা ও আধুনিক গদ্যের বিকাশে তাঁরা অবদান রেখেছেন। বাংলা ভাষার মুদ্রণ প্রকাশালয় প্রতিষ্ঠার গৌরবের দাবিদারও যিশুখ্রিষ্টের অনুসারীরা।
যিশুখ্রিষ্টের বেশির ভাগ অনুসারী ২৫ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন হিসেবে পালন করছে। তবু তিনি যতটা ইতিহাসের, তার চেয়েও বেশি আধ্যাত্মিকতার। যতটা না সম্প্রদায়ের, তার চেয়ে বেশি মানবতার। মানবতার এই মহাপুরুষের মধ্য দিয়ে মানবতারই সৃজন ঘটেছে।

এই দিনে আমার খ্রিষ্টান ভাইবোনদের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, 
লেখক, গবেষক। 
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages